উচ্চশিক্ষায় উপেক্ষিত মায়ের ভাষা।যে ভাষার জন্য এত লড়াই সংগ্রাম সেই মায়ের ভাষা আমাদের শিক্ষাক্রমে নেই।সবক্ষেত্রে তার অপব্যবহার।

 

চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞানে বাংলা বই নেই।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে ইংরেজি।
বাংলা ভাষায় বই রচনা ও অনুবাদ বাড়ানোর পরামর্শ।

উচ্চশিক্ষায় উপেক্ষিত মায়ের ভাষা।
উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা বাংলার কদর নেই বললে চলে। চিকিৎসা, প্রকৌশল, বিজ্ঞান, ব্যবসায়সহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা এখনো ইংরেজি ভাষায় রচিত বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানও হচ্ছে ইংরেজি ভাষায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহার শুধু কথাতেই রয়ে গেছে।

শিক্ষাবিদেরা বলছেন, উচ্চশিক্ষা রাষ্ট্রভাষায় হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে দেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষায় বইয়ের সংকট রয়েছে। বাংলায় রচিত ও অনুদিত বইয়ের সংখ্যা বাড়লে উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহারও বাড়বে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে এর বিকল্পও নেই।

শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষা আমাদের আয়ত্ত করতে হবে। তবে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সুযোগও থাকা উচিত। অন্তত বিদেশি বিভিন্ন লেখকের বই অনুদিত হতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের বিষয়টি অনুধাবন করা সহজ হবে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল ভাষাশহীদদের ত্যাগের বিমিময়ে।। সেই পথ ধরে ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার তেমন নেই। অথচ মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব-ভাষা তালিকায় বাংলার অবস্থান পঞ্চম এবং বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে এর অবস্থান সপ্তম। আর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ ইংরেজিতে কথা বললেও মাতৃভাষা হিসেবে এর অবস্থান তৃতীয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু কিছু বিভাগে বাংলা ভাষায় রচিত ও অনুদিত কিছু বই আছে। কিন্তু বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এবং চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যবসায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র বলছে, বিজ্ঞান অনুষদ, জীববিজ্ঞান অনুষদ, আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ১৩টি বিভাগে মোট ৩ হাজার ২০১টি বইয়ের রেফারেন্স দেওয়া হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষায় বইয়ের সংখ্যা মাত্র ৩৪। এসব অনুষদের বাকি বিভাগগুলোতেও বাংলায় রচিত ও অনূদিত বই হাতে গোনা। তবে কলা অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত বেশ কয়েকটি বিভাগে বাংলা ভাষায় বই পড়ানো হয়। বাণিজ্য অনুষদের বিভাগগুলোতেও বইয়ের বেশির ভাগ ইংরেজি ভাষায়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী ফারাহ জাহান শুচি বলেন, উচ্চতর শিক্ষায় বাংলা ভাষায় মানসম্মত ও বিষয়ভিত্তিক বইয়ের অভাবের কারণে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভাষায় রচিত বই পড়তে হয়। উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার বাড়াতে বাংলা ভাষায় বই বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা একান্ত প্রয়োজন। এ নিয়ে উদ্যোগ রয়েছে, তা আরও বাড়াতে হবে।

চিকিৎসা ও প্রকৌশল উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড ম্যাটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র নাসির উদ্দীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের কোনো বই বাংলায় নেই। প্রকৌশলের কোনো বই বাংলায় অনুবাদও হয়নি। বাংলায় বই থাকলে বিষয়টি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারতাম।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এহতেশামুল হক সামি বলেন, তাদের সিলেবাসেই বাংলা ভাষায় কোনো বই নেই। চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইগুলো বাংলায় যথাযথ অনুবাদও হয়নি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিবিএ, এমবিএ, কম্পিউটার সায়েন্সসহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষার নির্ভরতা আরও বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ ড. শিশির ভট্টাচার্য বলেন, উচ্চশিক্ষা ইংরেজিতে হতে পারে, সেটা সমস্যা নয়। তবে এতে সবার জন্য উচ্চশিক্ষা উন্মুক্ত থাকছে না। তিনি বলেন, ‘সবাইকে যদি আমরা উচ্চশিক্ষা দিতে চাই, তাহলে উচ্চশিক্ষা রাষ্ট্রভাষায় হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। শিক্ষাটা মাতৃভাষায় করা, এটা রাষ্ট্রের কাজ। উদ্যোগটা কীভাবে কানাডা, কোরিয়া নিয়েছে, তা দেখতে হবে। উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রভাষা ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা করবে না, তাদের জরিমানা করতে হবে।’

উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষা উপেক্ষিত কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে লেখক-অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলে হয়তো একটা উপায় হতো। কিন্তু নতুন ধরনের উপনিবেশ স্থাপনের প্রকল্প নিয়েছে “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়”। আর আমাদের সমাজ তার অনুগ্রহে বাঁচে। এই মায়াকান্না কেন করেন?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *